সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৩ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে নাহিদ হাসান (২৩) নামের একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৪ সংবাদকর্মী, অর্ধশত শিক্ষার্থীসহ শতাধিক ব্যক্তি। সকাল থেকে সংঘর্ষ শুরু হলেও দুপুর পর্যন্ত ওই এলাকায় কোনো পুলিশ ছিল না বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন।
ফলে নীলক্ষেত থেকে সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত পুরো এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, এর আগে গত সোমবার মধ্যরাতে প্রথম দফায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। তবে রাতে পুলিশের লাঠিপেটা এবং তাদের ওপর টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপের অভিযোগ এনে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কলেজের সামনে মিরপুর রোডে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। এ সময় ব্যবসায়ীরাও সড়কে নামলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ অবস্থায় ওই এলাকায় গতকাল সব বিপণিবিতান ও দোকানপাট বন্ধ ছিল।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
নিউ মার্কেটের ৪ নম্বর গেটের ভেতরে ‘ওয়েলকাম’ ও ‘ক্যাপিটাল’ নামের দুটি ফাস্টফুডের দোকানের মালিক আপন দুই চাচাতো ভাই। ইফতারের সময় মার্কেটের ভেতরে হাঁটার রাস্তায় টেবিল পেতে ইফতারি বিক্রি করেন এই দুই দোকানি।
মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, গত সোমবার সন্ধ্যায় টেবিল পাতা নিয়ে ওয়েলকাম ফাস্টফুডের কর্মচারী বাপ্পী ও ক্যাপিটালের কর্মচারী কাওসারের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে দেশীয় অস্ত্র হাতে বাপ্পীর সমর্থক ১০-১২ তরুণ সেখানে আসে। এ সময় কাওসারের সমর্থকদের সঙ্গে তাদের কথা কাটাকাটি ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর বাপ্পীর সমর্থকরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দল নিয়ে কাউসারের দোকানে হামলা চালায়। এর পরই দুই পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়।
ওয়েলকাম ফাস্টফুডের মালিক ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের মালিক শহিদুল ইসলাম সরদারও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
নিউ মার্কেট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সাহেব আলী বলেন, ‘দোকানের কর্মচারীদের এক পক্ষের হয়ে ঢাকা কলেজের ছেলেরা এসেছিল। এরপর এই ঝামেলা শুরু। অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তদন্ত চলছে। ’
সিসিটিভি ফুটেজে যা পায় পুলিশ
একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সঙ্গে মিল পেয়েছে। পুলিশ জানায়, মূল ঘটনা ধরা পড়ে রাত ১১টা ৩ মিনিটে। রামদা হাতে সাদা টি-শার্ট পরা এক তরুণের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল মার্কেটের ওয়েলকাম ফাস্টফুডে ঢুকে। সেখানে দোকানের বাইরে হট্টগোল হয়। কিছুক্ষণ পর মার খেয়ে ওই তরুণরা পালিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হেলমেটধারী কিছু তরুণ ৪ নম্বর গেট ভাঙতে থাকেন। রাত ১২টার দিকে তারা ২ নম্বর গেট খুলে মার্কেটে ঢুকে ভাঙচুর করে বেরিয়ে যান। তখন ব্যবসায়ীসহ হকাররা ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
শিক্ষার্থীরা যা বলছে
ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের দাবি, ঢাকা কলেজের মাস্টার্সের দুই শিক্ষার্থী গত রবিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নিউ মার্কেটের একটি দোকানে খেতে যান। এ সময় দোকানকর্মীদের সঙ্গে তাঁদের কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে দুই শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। এমন খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে একদল শিক্ষার্থী নিউ মার্কেট এলাকায় গেলে দুপক্ষে সংঘর্ষ বাধে। রাতে আড়াই ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফায় ধাওয়াধাওয়ি হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং লাঠিপেটা ও টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুলিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে তাঁদের লাঠিপেটা করেছে। গতকাল পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে সাতজনসহ অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হন।
সকালে ফের সংঘর্ষ
রাতের ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাস্তায় নামে। এ সময় ব্যবসায়ীরাও বেরিয়ে এলে সংঘর্ষ শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, সকাল থেকে হাজার হাজার দোকান কর্মচারীকে লাঠি আর ইটপাটকেল নিয়ে নিউ মার্কেট ওভারব্রিজ এলাকায় অবস্থান নেয়। তাঁদের বেশির ভাগ চাঁদনী চক, গাউছিয়া ও অন্যান্য মার্কেটের ব্যবসায়ী।
নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির নেতা শাহীন আহমেদ দাবি করেন, ‘আমরা ছাত্রনেতাদের কথা দিয়েছিলাম, ব্যবসায়ীরা আর সংঘর্ষে জড়াবে না। এরপর সকালে কাদের ইন্ধনে এমনটি ঘটল আমার জানা নেই। ’
ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে, সকাল থেকে সংঘর্ষ শুরু হলেও পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল না। পুলিশ যথাসময়ে এলে পরিস্থিতি হয়তো এত দূর গড়াত না।
অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল না এমন অভিযোগ সত্য নয়। শুরু থেকেই আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি। ’
পুলিশের গুলি-টিয়ার শেল
সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিপেটা, ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল হাতে থাকা ব্যবসায়ীদের উল্লাস করতে দেখা যায়। সংঘর্ষকালে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যায়।
সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সকাল ১১টার দিকে ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজের গেটে এবং ব্যবসায়ীরা চন্দ্রিমা সুপারমার্কেটের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হেলমেট পরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কের পাশাপাশি কলেজের ছাদে অবস্থান নিয়ে ব্যবসায়ীদের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ছাদ আর সড়কে প্রতিরোধ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা পিছু হটে। ব্যবসায়ীরাও পাল্টা শিক্ষার্থীদের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। মিরপুর রোডের ওই অংশ দুই পক্ষের ছোড়া ইটপাটকেলে ভরে যায়।
একজন নিহত, আরেকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক
গত রাতে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাহিদ হাসান নিহত হন। তিনি নিউ মার্কেট এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন।
অন্যদিকে গুরুতর আহত ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি এখনো শঙ্কামুক্ত নন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। তাঁকে দেখতে রাতে হাসপাতালে যান কলেজের অধ্যক্ষ।
ঢাকা মেডিক্যালে ২৯ শিক্ষার্থী
সংঘর্ষে আহত অন্তত ২৯ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে ভর্তি শিক্ষার্থী কানন চৌধুরী অভিযোগ করেন, ‘আমাকে ঘেরাও করে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে ব্যবসায়ীরা। ’
কলেজ বন্ধ ঘোষণা, ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ
আগামী ৫ মে পর্যন্ত ঢাকা কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে গতকাল (১৯ এপ্রিল) বিকেলের মধ্যে শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত তাত্ক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, যেকোনো মূল্যে আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন তাঁরা।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মইনুল হোসেন বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থীর বাড়ি অনেক দূরে। তাই আমরা আজ (মঙ্গলবার) রাতেও শিক্ষার্থীদের হলে থাকার অনুমতি দিয়েছি। ’
নুরজাহান মার্কেটে দোকানে আগুন
সংঘর্ষের সময় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়েছে নিউ মার্কেট এলাকার নুরজাহান মার্কেটের একটি দোকান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেনের শিক্ষার্থীদের সংহতি
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সড়কে অবস্থান নেন ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরাও।
মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ
নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকায় বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্কয়ারে শিক্ষামন্ত্রী
গতকাল রাতে আহত শিক্ষার্থী মোশারফকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে যান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সেখানে তিনি বলেন, এ ঘটনায় বহিরাগতদের উসকানি থাকতে পারে। পরে আহতদের দেখতে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও যান।
এর আগে চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষামন্ত্রী সংঘর্ষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দায়ী করেন।
মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, আহত শিক্ষার্থী মোশারফের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি অন্য আহত শিক্ষার্থীদেরও খোঁজখবর রাখছেন।
Leave a Reply